English Channel Winner

অসম্ভবকে সম্ভব করে ইংলিশ চ্যানেল জয়ী মেদিনীপুরের আফরিন জাবি

২৯ জুলাই অভীষ্ট লক্ষ্যে অবতীর্ণ হয়ে ভারতীয় সময় সকাল ৭ টা ৪৫ মিনিটে সাঁতার শুরু করে ১৩ ঘন্টা ৪৫ মিনিট সময় নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন আফরিন

বিদ্যুৎ ভৌমিক : অদম্য জেদ ও ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে মানসিক দৃঢ়তার মিশেলে ক্রীড়া জগতে অসাধ্য সাধন করে উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে সাফল্য তুলে আনা সম্ভব, তা ১৩ ঘন্টা ৪৫ মিনিট সময় নিয়ে ২৯ জুলাই রাত্রি ৯ টা ৩১ মিনিটে ৩৪ কিমি জলপথ পেরিয়ে মেদিনীপুর জেলার প্রথম সাঁতারু হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করার দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিলেন মেদিনীপুর কলেজের সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী আফরিন জাবি ।তাঁর এই অভাবনীয় সাফল্য এই কারণেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে যে, বিগত ১৯১১ সালের ২৯ জুলাই বৃটিশ ক্লাবকে খালি পায়ে ফুটবল খেলে হারিয়ে ঐতিহ্যবাহী মোহনবাগান ক্লাব আই এফ এ শিল্ড জয়ী হয়েছিল।সেই স্মৃতি আজ মনে করিয়ে দিয়েছে মেদিনীপুরের আফরিন ।

সূত্রের খবর, মেদিনীপুর শহরের দেওয়াননগরের মেয়ে আফরিন ছোট বয়স থেকেই মেদিনীপুর সুইমিং ক্লাবে সাঁতারে মনোনিবেশ করে আসছেন । সে কারণে তিনি  জেলা ও রাজ্য স্তরে একাধিক সাফল্য অর্জন করেছেন।দীর্ঘদিন ধরে তিনি ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন ও সেমতো ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে একটানা ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত সাঁতার কাটার প্রক্রিয়ায় রত ছিলেন ।এমন কি কলকাতায় এসে সুভাষ সরোবরে ও গঙ্গাবক্ষে নিরলস সাঁতার কেটে গেছেন।অবশেষে কাঙ্খিত সময় ৯ জুলাই মেদিনীপুর থেকে দিল্লী হয়ে ইওরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন মেদিনীপুরের সাঁতারু ।কথা ছিল  আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তিনি ইংলিশ চ্যানেলে নামবেন । শারীরিক পরীক্ষা ঠিকঠাক থাকায় ২৯ জুলাই অভীষ্ট লক্ষ্যে অবতীর্ণ হয়ে ভারতীয় সময় সকাল ৭ টা ৪৫ মিনিটে সাঁতার শুরু করে ১৩ ঘন্টা ৪৫ মিনিট সময় নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন আফরিন ।তিনি জানান যে,ভেবেছিলাম ৮ ঘন্টায় পেরিয়ে যাবো।শেষ ১ কিলোমিটার প্রবল স্রোত আমাকে পেছনে ঠেলছিল ।প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল ।এক সময়ে মনে হলো, আর পারব না ।কিন্তু লড়াই ছাড়িনি।সারা গা হাত পায়ে  তখন অসহ্য যন্ত্রণা ।এখনও মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে ।

আফরিনের বাবা পিয়ার আলি পেশায় পরিবহন ব্যবসায়ী ।তিনি বলেন যে,১৪ জুলাই আফরিন দাদা ও বৌদির সঙ্গে লন্ডন পৌঁছে বাড়ি ভাড়া নিয়ে লন্ডনের ঠান্ডা জলে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন । কারণ ইংলিশ চ্যানেলের জল প্রচন্ড ঠান্ডা ।এই ঠান্ডা জলে নেমে দীর্ঘক্ষণ সাঁতার কাটলে হাত পা জমে যেতে পারে ।শরীরের সহ্য ক্ষমতা বাড়াতে বিশেষজ্ঞদের নির্দেশমতো তিনি  বড় বড় বরফের চাঁই কিনে এনে বাড়ির মধ্যে সেই বরফ গলা জলে গা ডুবিয়ে বসে থাকতেন আফরিন । 

মেদিনীপুরের আফরিনের  বিরাট সাফল্যের পেছনে অনেক মানুষের অবদানের কথা স্বীকার করেন বাবা পিয়ার আলী ।আফরিনের সুইমিং কোচ শান্তনু ঘোষ জানালেন যে, প্রথম দিকে বোঝা যায় নি যে,;আফরিনের মধ্যে এত প্রতিভা ।২০২৩ সালে মুর্শিদাবাদ গঙ্গাবক্ষে ৮১ কিলোমিটার সাঁতারে মেয়েদের মধ্যে আফরিন  দ্বিতীয় স্হান পায়।তারপরই ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার স্বপ্নটা চাগাড় দিয়ে ওঠে ।তিনি আরও জানান যে, ইংলিশ চ্যানেল পার হতে গেলে যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হয়, তা আমাদের জানা ছিল না ।তাই ওকে কলকাতায় প্রশিক্ষক বিশ্বজিৎ দে চৌধুরীর কাছে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছিল ।তাঁর ( কোচের  )পরামর্শ অনুযায়ী একটানা ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা জলে থাকতে শুরু করেন আফরিন ।তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন নীলাঞ্জনা বক্সী, রূপসা পাল, সৃজিতা ঘোষ  , অনীশ মাহাতো, সোহম ঘোষের মতো সাঁতারুরা।শান্তনু আরও বলেন যে, একা একটানা সাঁতার কাটা মুশকিল ।তাই দু- তিন ঘন্টা করে তাঁরা আফরিনের সঙ্গে সাঁতার কাটতেন।আফরিনের সঙ্গী নীলাজ্ঞনা বক্সী জানান, আমরা জানতাম, আফরিন সফল হবে ।

লন্ডন পাড়ি দেওয়ার আগে আফরিনের এই সাহসী পদক্ষেপকে কুর্নিশ জানাতে মেদিনীপুর সুইমিং ক্লাব এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন ।সেই সঙ্গে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান মেদিনীপুর জেলা স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট অ্যাকাডেমি, মেদিনীপুর লায়ন্স ক্লাব, মেদিনীপুর সুইমিং অ্যাসোসিয়েশন ও অন্যান্য সংগঠন ।অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আফরিনের তিন  কোচ বাবুন নাথ, প্রদীপ বেরা , শান্তনু ঘোষ ছাড়াও ক্লাবের অন্যান্য সাঁতারু ও সদস্যরা সহ আফরিনের বাবা মা ও আত্মীয়স্বজন ।আফরিনের কাছে  লন্ডন যাওয়ার আগে তাঁর মা সাবিনা পারভীন জানান যে, ছেলের মতো মেয়েকেও তিনি স্বাধীনভাবে বড় করে তুলেছেন ।ঠিক করেছেন, মেয়ের স্বপ্ন তিনি  কিছুতেই ভাঙ্গতে দেবেন না ।ভবিষ্যতে জিব্রাল্টার প্রণালী ও পক্ প্রণালী পার করাই আফরিনের লক্ষ্য ।

আফরিনের ইংলিশ চ্যানেল জয়ের খবর আসা মাত্রই মেদিনীপুর সুইমিং ক্লাবে বিজয় পতাকা উড়িয়ে ক্লাব চত্বরে আতশবাজি প্রদর্শনী চলে।বেজায় খুশি আফরিনের বাবা মা ও সুইমিং ক্লাবের সম্পাদক পল্লব কিশোর চ্যাটার্জি ।মেদিনীপুর সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক তথা আফরিনের কোচ শান্তনু ঘোষ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন যে,আফরিনের ১৪ বছরের পরিশ্রম আজ সার্থক হলো।আফরিন আগেও রাজ্য ও জাতীয় স্তরে অনেক সাফল্য পেয়েছে।তবে আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিযোগিতায় এই সাফল্য খুব গর্বের ও আনন্দের ।আফরিনের এই সাফল্যে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা শাসক খুরশেদ আলি কাদেরী, পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার, মেদিনীপুরের বিধায়ক সুজয় হাজরা, মেদিনীপুর পৌরসভার পৌরপিতা সৌমেন খান ও এলাকার গুণীজনেরা অভিনন্দন জানিয়েছেন ।
ছবি  : সংগৃহীত ।

Advertisement