Plane Crash,
উপেক্ষিত সতর্কবার্তা, অজস্র প্রাণহানি: বোয়িং-এর গাফিলতিতে যাত্রী সুরক্ষা প্রশ্নের মুখে, ভারতের কী করণীয়?
৭৮৭ ড্রিমলাইনার নিয়ে ভারতের আহমেদাবাদে ঘটে গেল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। বহুবার সাবধান করা সত্ত্বেও বোয়িং-এর ভেতরের ত্রুটি, অকেজো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও গুণমান নিয়ন্ত্রণে গাফিলতি অবশেষে প্রাণ কাড়ল ২৪০ জনের। সাবেক কোয়ালিটি ম্যানেজার জন বার্নেটের হুঁশিয়ারি আজ বাস্তব রূপ নিল। ভারতের জন্য এখন জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়।

প্রতিবেদন: শান্তনু মাইতি (১৩ জুন ২০২৫ | দুপুর ২:৫০ | কলকাতা)
একটি তীব্র শব্দ। তারপর ধ্বংসস্তূপ। এবং তার মাঝেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা এক আহত মানুষের, যিনি জানতেন না, তিনি বেঁচে আছেন কি না। ভারতের আকাশে ঘটে গেল এক শতাব্দীর অন্যতম হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা—একটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার বিমান উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল আহমেদাবাদের একটি মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলের ওপর। মৃত ২৪০ জনেরও বেশি।
এবার আর শুধুমাত্র “সতর্কবার্তা উপেক্ষা” নয়—এটা প্রমাণ যে, সেই সতর্কবার্তা উপেক্ষা করাই ডেকে আনছে ভয়ঙ্কর পরিণতি।
ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা: বাস্তবে পরিণত সতর্ক সংকেত
১২ জুন, বৃহস্পতিবার, সকাল ১১টার কিছু পর, এয়ার ইন্ডিয়া-র AI171 বিমানটি আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনের গ্যাটউইক-এর উদ্দেশে রওনা দেয়। উড্ডয়নের ঠিক ৩০ সেকেন্ড পরেই বিকট শব্দ—এরপর বিমানটি মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের ওপর ভেঙে পড়ে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিমানে থাকা ২৪২ জনের মধ্যে মাত্র একজন বেঁচে আছেন।
বেঁচে যাওয়া যাত্রীর নাম রমেশ বিশ্বেশকুমার, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক, তিনি বলেন, “চোখ মেলতেই চারপাশে কেবল মৃতদেহ, ধ্বংসাবশেষ। আমি কোনওভাবে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে যাই।” তাঁর ভাই, অজয়, একই বিমানে ছিলেন—তিনি নিখোঁজ।এই ঘটনায় প্রাক্তন গুজরাট মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানিরও মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
সাবধানবাণী যাঁর, তিনি আজ আর নেই
বোয়িং-এর প্রাক্তন গুণমান ব্যবস্থাপক জন বার্নেট ২০১৯ সালেই একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন, বোয়িং-এর ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমানে অক্সিজেন মাস্কের ২৫ শতাংশই কাজ না করতে পারে। তিনি জানিয়েছিলেন, বহু যন্ত্রাংশ স্ক্র্যাপ থেকে তৈরি, এবং বিমানের নিরাপত্তা পরীক্ষায় বড়সড় দুর্বলতা রয়েছে।
২০২৪ সালের মার্চে, সাক্ষ্যদানের মাঝেই, এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বার্নেট দক্ষিণ ক্যারোলিনায় নিজের গাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যান। যদিও পুলিশ জানিয়েছিল, এটি আত্মহত্যা, বার্নেটের আইনজীবী এবং পরিবার এটিকে একপ্রকার “প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাকাণ্ড” বলেই মনে করছেন।
জানুয়ারি ২০২৫: দরজা খুলে যায় মাঝআকাশে
মাত্র কয়েক মাস আগে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমান মাঝআকাশে ওড়ার সময় হঠাৎ একটি দরজা খুলে গিয়েছিল। পরে তদন্তে দেখা যায়, দরজার চারটি বোল্ট লাগানোই হয়নি।
জুন ২০২৫: অক্সিজেন মাস্ক কাজ করেনি
এবং তার কয়েক দিন পরেই আরও একটি বোয়িং ড্রিমলাইনারে দেখা যায়, জরুরি পরিস্থিতিতে অক্সিজেন মাস্কই কাজ করছে না। এই ঘটনাগুলি সরাসরি জন বার্নেটের দেওয়া সতর্কবার্তার সাথে মিল খেয়ে যাচ্ছে। বোয়িং-এর ভিতরকার নিরাপত্তা সংস্কৃতি, অযথা উৎপাদন তাড়াহুড়ো ও খরচ কমানোর মানসিকতা এখন পরিণত হচ্ছে গণ-দুর্ঘটনায়।
প্রযুক্তিগতভাবে কি বোয়িং ড্রিমলাইনার নিরাপদ?
যখন একজন ইঞ্জিনিয়ার প্রমাণসহ বলেন, বিমানে বসানো মাস্কের এক-চতুর্থাংশ অকেজো হতে পারে, তখন তার গুরুত্ব অনুধাবন না করে শুধুমাত্র মুনাফা ও সময়সীমার কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যে কতটা আত্মঘাতী হতে পারে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ এখন আহমেদাবাদ।বোয়িং কোম্পানি যদিও দাবি করে, “সকল সিস্টেম আলাদা করে পরীক্ষা করা হয়,” কিন্তু বাস্তবের ঘটনাগুলি যেন সেই দাবি একের পর এক খণ্ডন করে চলেছে।
ভারতের সামনে এখন কী করণীয়?
ভারতের বিমান সংস্থাগুলি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার মডেল বহু বছর ধরেই ব্যবহার করে চলেছে। এখন এই ঘটনার পর প্রশ্ন উঠছে—
• ডিজিসিএ (DGCA) কি এই মডেলগুলির পূর্ণাঙ্গ প্রযুক্তিগত পরীক্ষা করছে?
• ভারত কি এখনও FAA-এর উপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে?
• আমরা কি যাত্রী নিরাপত্তা নিয়ে আপস করছি আন্তর্জাতিক প্রভাবের ভয়ে?
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের করণীয় হল:
1. অবিলম্বে সমস্ত বোয়িং ৭৮৭ মডেল বিমানের বিশেষ পরিদর্শন চালানো।
2. প্রতিটি বিমানের অক্সিজেন সিস্টেম এবং ফিজিক্যাল পার্ট পরীক্ষা করে তার রিপোর্ট প্রকাশ করা।
3. আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে বোয়িং-এর নিরাপত্তা সংস্কৃতি পর্যালোচনা করা।
4. প্রয়োজনে বোয়িং-এর নির্দিষ্ট কিছু মডেল বা সংস্থার উপরে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করা।
উপসংহার: সতর্কবার্তা আর অগ্রাহ্য নয়
এবার আর শুধু “ভবিষ্যৎ আশঙ্কা” নয়—এটা এক মর্মান্তিক বাস্তবতা। জন বার্নেটের গলা স্তব্ধ হলেও, তার সাবধানবাণী এখন প্রতিটি বিধ্বস্ত বিমানের পাখায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।যাত্রীদের জীবনের দায়িত্ব কোনও কর্পোরেট ডেডলাইন বা আন্তর্জাতিক চাপের কাছে কখনোই তুচ্ছ হতে পারে না।

Comments